বিচার
(নির্বাচিত অংশ)
১. প্রাথমিক তদন্ত
‘তাহলে’, খাতার পাতা ওলটাতে ওলটাতে জরিপ করার ভঙ্গিতে ক-এর দিকে ঘুরে তাকিয়ে তদন্তবিচারপতি বলে ওঠেন, ‘আপনি পেশায় রংমিস্তিরি?’ ‘আজ্ঞে না’, বলেন ক, ‘বরং মস্ত এক ব্যাঙ্কের প্রধান কর্মকর্তা’। এই উত্তরের জেরে নীচে ডান দিকের দল এমনি বেদম অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, যে ক নিজেও তাদের হাসাহাসিতে সামিল হতে বাধ্য হন। দু-হাত দিয়ে হাঁটু আঁকড়ে, তাতে ঠেকনা দিয়ে বসেছিল লোকজন, আর ভীষণ কাশির দমক ওঠার মতো থরথর করে কেঁপে উঠছিল। এমনকি গ্যালারির এক-দুজনও হাসিতে যোগ দিয়েছিল। গ্যালারির এই শোরগোলের একটা বিহিত করার উপক্রমে তদন্তবিচারপতি তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন, গ্যালারির বাকিদের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছোঁড়েন, আর তাঁর এমনিতে তেমন চোখে-না-পড়া নিরীহ ভুরুযুগল চোখের উপরে মিশমিশে কালো আর মস্ত বড় হয়ে ঠিকরে বেরোয়।
(…)
‘মাননীয় তদন্তবিচারপতি মশাই, আপনার প্রশ্ন, আমি রঙের মিস্তিরি কিনা - উপরন্তু আপনি মোটেই প্রশ্ন করেননি, বরং তা আমার মুখের উপর বলেছেন - এটা এই মামলা মোকদ্দমার আপাদমস্তক ধরনটার জন্য একেবারে মার্কামারা, যা আমার বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে। আপনি প্রতিবাদ করতে পারেন, যে এটা মোটেই কোনো মামলা মোকদ্দমা নয়, সেটা খুব খাঁটি কথা হবে, এটা শুধু তখনি কোনো মামলা মোকদ্দমা হতে পারে, যখন আমি তাকে সেরকম কোনোকিছু বলে মেনে নেবো। কিন্তু আমি এখন সেটা এক মুহূর্তের জন্য মেনেই নিলাম, কতকটা করুণা করেই। এটাকে আদৌ বিবেচনার মধ্যে আনতে চাইলে করুণা করা ছাড়া এর পক্ষ নেওয়া সম্ভব নয়। আমি বলছিনা এটা একটা রদ্দি মামলা মোকদ্দমা, কিন্তু আপনার আত্মোপলব্ধির জন্য এই ধারণাটা আমি পেশ করতে চাই।
(…)
‘আমার সঙ্গে যা ঘটেছে’, আগের থেকে কিছুটা নিচু স্বরে ক বলতে থাকেন, আর সামনের সারির মুখগুলোর দিকে বারবার তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন, যা তাঁর কথা বলার মধ্যে কেমন একটা অস্থির আনমনা ভাব এনে ফেলে, ‘আমার সাথে যা ঘটেছে তা কেবল একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এবং সেই অনুযায়ী আহামরি জরুরি কিছু নয়, যেহেতু আমি এটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিনা, কিন্তু এটা একটা আইনি ব্যবস্থার প্রতীকস্বরূপ, যেমনটা অনেকের বিরুদ্ধেই নেওয়া হয়ে থাকে। আমি এখানে তাদের হয়ে দাঁড়াতে এসেছি, নিজের জন্য নয়।
(…)
‘বক্তার সাফল্য আমার কাম্য নয়’, ক এই বিবেচনা থেকে বলে ওঠেন, ‘তা আমার প্রাপ্যও নয়। মাননীয় তদন্তবিচারপতি নিশ্চিত আরও অনেক ভালো বক্তা, সেটা তো তাঁর পেশাতেই পড়ে। আমি যা চাই, তা হলো একটা সাধারণ ভুল নিয়ে কেবল একটা প্রকাশ্য আলোচনা। শুনুন আপনারা: মোটামুটি দিন দশেক আগে আমাকে গ্রেফতার করা হয়, গ্রেফতারের ব্যাপারখানা নিয়ে আমার নিজেরই হাসি পায়, কিন্তু সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। সকাল সকাল বিছানায় আমার ওপর হামলা করা হয়, হয়তো কারো - তদন্তবিচারপতি যা বললেন সে অনুযায়ী তা অসম্ভব নয় - আদেশ ছিল আমারই মতো নির্দোষ কোনো এক রংমিস্তিরিকে গ্রেফতার করবার, কিন্তু সে আমায় ধরে বসলো। পাশের ঘরটা দুটো অভদ্র পাহারাদার দখল করে রেখেছিল। আমি যদি এক খতরনাক ডাকু হতাম, তাহলে কারোর পক্ষে এর চেয়ে ভালো সাবধানতা অবলম্বন করার দরকার হত না। তাছাড়া এই পাহারাদারগুলো ছিল নীতিহীন জঘন্য ইতর প্রকৃতির, বকে বকে তারা আমার কানের পোকা নাড়িয়ে দেয়, ঘুষ নেওয়ার মতলব করে, কায়দা করে আমার কাপড়চোপড় হাতড়ানোর ফন্দি করে, আমারই চোখের সামনে আমার প্রাতঃরাশ গবগব করে খেয়ে ফেলার পর আমার জন্য নাকি নাস্তা এনে দেবে তাই টাকা চায়। শুধু এই নয়, আমাকে একটা তৃতীয় ঘরে এক তত্ত্বাবধায়কের সামনে নিয়ে আসা হয়। এই ঘরটা ছিল একজন মহিলার যাকে আমি ভীষণ সমাদর করি, আর আমায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হলো, কিভাবে এই ঘরটাকে আমার জন্য, কিন্তু আমার কোনো দোষ ছাড়াই, পাহারাদারগুলোর আর তত্ত্বাবধায়কের উপস্থিতির দরুন কতকটা কলুষিত করা হলো। শান্ত থাকা সহজ ছিল না। অথচ আমি তা পারলাম, আর একেবারে শান্ত গলায় তত্ত্বাবধায়ককে জিজ্ঞেস করলাম - উনি যদি এখানে থাকতেন, নিশ্চয়ই সায় দিতেন - আমায় কেন গ্রেফতার করা হল। সেই তত্ত্বাবধায়ক, যাকে আমি এখন আবারও আমার সামনে দেখতে পাচ্ছি, আমার উল্লিখিত মহিলার চেয়ারে কেমন এক নির্বোধ ঔদ্ধত্য’র দর্শনমূর্তি হয়ে বসে, এবার কি উত্তর দিলেন? মহাশয়গণ, আদতে তিনি আমায় কোনো উত্তরই দেননি, তিনি আমায় গ্রেফতার করেন আর তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে্ন। অবশ্যই উনি আরও একটা ব্যাপার ঘটান, আর সেটা হল এই মহিলার ঘরে আমার ব্যাঙ্কের তিনজন অধস্তন কর্মচারীদের হাজির করা, যারা এই মহিলার ছবি আর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নাড়াঘাঁটা করে অগোছালো করায় ব্যস্ত ছিল।
(…)
‘এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই’, খুব নরম স্বরে ক বলতে থাকেন, যেহেতু এই পুরো সমাবেশের টানটান মনোযোগ তাকে আনন্দ দিচ্ছিল, এই স্তব্ধতায় একটা গুঞ্জন উঠছিল, যা অতি উচ্ছ্বসিত সমর্থনের থেকেও বেশী উত্তেজক, ‘এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যে এই আদালতের সমস্ত রায়-বিচারের পিছনে, অর্থাৎ আমার ক্ষেত্রে এই গ্রেফতার, আর আজকের তদন্তের পিছনে বড়ো কোনো সংগঠন রয়েছে। এমন একটা সংগঠন, যা কেবলমাত্র ঘুষখোর পাহারাদার, হাস্যকর তত্ত্বাবধায়ক, আর তদন্তবিচারপতি, যাঁরা কপাল খুব ভালো থাকলে বড়জোর ভদ্র হতে পারেন, তাদেরই নিয়োগ করে না, উপরন্তু যারা অসংখ্য চাকরবাকর, লিপিকার, দারোগা প্রভৃতি কাজের লোক, এমনকি হয়তো ফাঁসুড়েদের এক অপ্রতিরোধ্য দল নিয়ে এক উচ্চ থেকে উচ্চতর বিচার ব্যাবস্থা বজায় রাখে, এই কথাগুলো বলতে আমি ভয় পাই না। আর এই বিশাল সংগঠনের উদ্দেশ্য, মহাশয়গণ? সেটা হল নির্দোষ লোকেদের গ্রেফতার করা আর তাদের বিরুদ্ধে অর্থহীন, আর বেশীভাগ সময়ে, যেমনটা আমার ক্ষেত্রে, নিষ্ফল মামলা-মোকদ্দমা চালিয়ে যাওয়া। এই সামগ্রিক অর্থহীনতার মাঝে আধিকারিকদের নিকৃষ্টতম দুর্নীতি কোন উপায়ে এড়ানো যেতে পারে? তা অসম্ভব, এমনকি সর্বোচ্চ বিচারপতিরও সাধ্যের বাইরে। এই কারণেই যারা গ্রেফতার হয়, পাহারাদারেরা তাদের পোশাক শরীর থেকে ছিনিয়ে নেয়, তত্ত্বাবধায়করা অচেনা বাড়িতে হানা দেয়, এই কারণেই নিরপরাধীদের জেরার বদলে সমস্ত জমায়েতের সামনে অপমানিত হতে হয়।
(...)
যতদূর দেখা যায় সকলের গায়ে এই একই ব্যাজ আঁটা ছিল। সকলে একে অপরের সাথে জোট বেঁধে ছিল, দৃশ্যত ডানদিকের আর বাঁদিকের দলেরা, আর যেই তিনি হঠাৎ পিছন ফিরে তাকালেন, তদন্তবিচারপতির কলারে সেই একই ব্যাজ তাঁর চোখে পড়লো, যিনি কোলের উপর হাত রেখে শান্তিমনে নীচের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। ‘ও’, ক চেঁচিয়ে ওঠেন, আর শুন্যে দু’বাহু ছুঁড়ে দেন, এই আকস্মিক উপলব্ধি কিছুটা জায়গা দাবি করছিল - ‘যা দেখতে পাচ্ছি তোরা সকলেই কর্মচারী, তোরা হলি সেই নষ্টের দল যাদের বিরুদ্ধে আমি কথা বলছিলাম, তোরা সকলে এখানে গাঁদিয়ে ঢুকেছিস, শ্রোতা আর টিকটিকির বেশে, ভুয়ো দল গঠন করেছিস, আর এক দল আমায় বাজিয়ে দেখার জন্য হাততালি দিলি, তোরা শিখতে চাইলি, কি ভাবে নিরপধারীকে ফাঁদে ফেলা যায়। এখন আশা করি তোদের এখানে থাকাটা বৃথা হয়নি, হয় তোরা আলোচনা করেছিস, যে কেউ আশা করছিল তোরা নিরপরাধীর পক্ষ সমর্থন করবি, - বলতে দে নয়ত থাবড়া খাবি’, থরথর কাঁপতে থাকা এক বুড়োর দিকে খিঁচিয়ে ওঠেন ক, যে তাঁর বড্ড কাছে ঘেঁষে এসেছিল - ‘আর নয়ত তোরা সত্যি কিছু শিখেছিস। আর সেই সাথে আমি তোদের কারবারের মঙ্গল কামনা করি।‘ টেবিলের ধারে পড়ে থাকা টুপিটা তড়িঘড়ি তুলে নিয়ে তিনি চারিদিকের নিস্তব্ধতার মাঝে, অবশ্যই যা আপদমস্তক হতচকিত হওয়ার মতো নিস্তব্ধতা, দ্রুত বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দেখা গেল তদন্তবিচারপতি ক-এর থেকেও চটপটে, কারণ তিনি দরজার পাশে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ‘এক সেকণ্ড’, তিনি বললেন, ক দাঁড়িয়ে রইলেন, কিন্তু তদন্তবিচারপতির দিকে না তাকিয়ে দরজার দিকে ফিরে, যার হাতল তিনি ইতিমধ্যেই আঁকড়ে ধরেছিলেন। ‘আমি আপনাকে শুধু সতর্ক করতে চাইছিলাম’, বললেন তদন্তবিচারপতি, ‘যে আপনি আজ - হয়তো এখনও তা আপনার চেতনায় আসেনি - নিজের থেকে সেই সুযোগটা ছিনিয়ে নিলেন, যা কোনো শুনানি আসামীদের সবসময় দিয়ে থাকে।‘ ক হাসতে হাসতে দরজা খোলেন। ‘তোরা অপদার্থরা’, চেঁচিয়ে বলেন, ‘তোদের সবকটাকে আমি শুনানি উপহার পাঠাবো’, দরজা খুলে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। পিছনে ফেলে আসা পুনরায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা জমায়াতের কলরোল ক্রমে বেড়ে উঠতে থাকে, ঘটনাগুলো তারা হয়তো পড়ুয়াদের মতো কাটা-ছেঁড়া করতে আরম্ভ করে।
(অনুবাদ: শৌণক দাশ)
Translation: Sounak Das
Read by: Shekhar Sarkar